কবিতা- স্রষ্টা ও সে

স্রষ্টা ও সে
– সঞ্জয় বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

কোটি বছরের নিদ্রার পর চোখ মেললেন স্রষ্টা।
নিরালা একাকিত্বে নিঃসঙ্গ হৃদয় আলাপ করে নিজের সাথেই।
সময় বড় ধীর, আরও হানে একাকিত্বের শানিত আয়ুধ মস্তিষ্কের স্নায়ুতে স্নায়ুতে।
হঠাৎ দোলা লাগে দেহে মনে।
মননের তরঙ্গ ছুঁয়ে যায় স্রষ্টার আঙুল।
সৃষ্টির আনন্দে উদ্বেল হৃদয় একাগ্র হয়
কোটি বছরের সৃষ্টি সাধনায়।
মুছে যায় কালের হিসাব, ক্ষণের বেগে
ধায় যুগ। পূর্ণতা পায় অনাবিল সৃষ্টিসুখ।
ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির মুহূর্তে স্রষ্টার তৃপ্তির
চরম প্রকাশ তাঁর অট্টহাসিতে।
সেই অট্টরব, সৃষ্টির সংবাদ নিয়ে ধ্বনিত হয়
মহাশূন্যের কোণে কোণে। স্রষ্টার সৃষ্টি,
রূপ নেয় আপন গতিতে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তিনি পান করেন, নিজ সৃষ্টির সুধারস।

নিদাঘে ধরিত্রীর মতো, কিংবা পিপাসার্ত চাতকের মতো।

পূর্ণ করেন নিজের অন্তর দিন রাত যুগে মাপের অতীত
সেই অনন্ত কাল ধরে।
অগ্নিময় গোলকের সহস্র কোটি বছরের উত্তরন সবুজে, নীলিমায়।
ধীরে ধীরে ক্লান্তি আসে দৃষ্টিতে। ক্লান্তি আসে
অনুভবে, সময় রথের চাকায় ভর করে।
নিজের হাতে সৃষ্ট যা কিছু, সব লাগে জীর্ণ,
যেন জরাগ্রস্ত ক্রীড়নক।
স্রষ্টার হৃদয় আবার ব্যাকুল, আবার দোলা লাগে মস্তিষ্কের গোপন কোনোখানে, নব সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায়।
স্থান নাই স্থান নাই নূতনের, যেন রব ওঠে
অসীম ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে।
নূতনের নাই আবাহন পুরাতন বিদায়ের আগে।
জাগে সংশয়, জাগে দ্বন্দ্বের দোলা তাঁর মনে।
ধংসের বেদীতে নূতনের আবাহন!

নিজ হাতে কাল গর্ভে নিজের সৃষ্টি! কালান্তক অসাধ্য সাধনে।

উপায় কি আছে কিছু? ভাবনার জটাজাল স্রষ্টার মনে।

অবশেষে আনিলেন প্রাণী রূপে শমনের দূত ধরাতলে,

দানিলেন কাহারে নগ দেহ, কাহারে বা করিলেন সমৃদ্ধ
নখ, দন্ত, গরলে, লয়ের নিমিত্তে আপন সৃষ্টি।
তারা মারে, মরে, জেতে হারে, আর যায় কালের
সমাধি পরে। বেঁচে রয় সৃষ্টি তাঁর আরও প্রাণ
আরও রূপ নিয়ে, আরও অসীম সময় বেয়ে।
পাঠান ধেয়ে কত শত বজ্রানল, দাবানল।
ধুলিজাল, অগ্নিভস্ম ঘেরা ঘূর্ণি, প্রলয় রূপেতে
মাতে কত জলচ্ছাস।
তবুও অটল সে রচনা, আসেনা যে পরিণতি
মনে প্রাণে চান রূপকার। উপলব্ধি করেন
অন্তরে অন্তরে, অক্ষম তাঁর ধূমজাল বজ্রানল
কিংবা নখ দন্ত গরলের তেজ, নাশিতে সৃষ্টি তাঁর,শত প্রয়াসে। বয়ে যায় কত কাল,
অপ্রসন্ন হৃদয়ে, শেষে আনিলেন এক দেহধারী ,
ক্ষুদ্রকায় শক্তিহীন দুর্বল অতি। কেড়ে নেন
নখ দাঁত খড়গের বল, দেহের গরল দেন মনে। ভরে দেন চাতুর্যের ভ্রান্ত অহমিকা
অন্তরে অন্তরে। দুর্বল সে, নিজেরে ভাবে
শক্তিধর অতি, ভ্রান্ত মতি, হেলায় অন্যেরে দেয়
নীচের আসন। রাজার আসনে বসে ত্রাসের
শাসনে সব বাঁধিবারে চায়। খুঁজে নেয় অস্ত্র
তার, দেশ, ধর্ম, ঐশ্বর্যের রূপে। উথলিয়া
পাতাল, ধরা, ধায় অন্তরীক্ষ পানে, হানে শত
ধংসের বাণ, স্রষ্টার সৃষ্টির পুষ্পে, পত্রে, মূলে।
সে মরেনা, মারে, আর নিজ হাতে গড়ে তোলে
জতুগৃহ, আপনার তরে।
সস্মিত ওষ্ঠ কোণে স্রষ্টা আবার বসেছেন ধ্যানে
সৃষ্টির নূতন বীজের সন্ধানে পরম তৃপ্তিতে।
একদিন সব নাশী সেই দেহধারী, প্রবল অনলে
জ্বালিবে জতুগৃহ।
শেষের দিনের শেষে, স্রষ্টা আবার করবেন নূতনের আবাহন অকৃপণ দানে,
আর সেই দেহধারী, নিজ ধংসের পড়ে আপনারে দেবে বিজয়ীর মালা।
তার মূর্খ আস্ফালন, ধংস করি নিজ ঘর, মানুষ আমি, আমি মহা- শক্তিধর।

Loading

Leave A Comment